তারা বলছেন, এর ফলে সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে এবং সামনের দিনগুলোতে হাসপাতালগুলো বাড়তি রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাবে। যার ফলে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুর হারও অনেক বেড়ে যেতে পারে।
শনিবার সকাল পর্যন্ত দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও ১,৭৬৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৬১০ জনে দাঁড়াল। এছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৪৪ হাজার ৬০৮ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক ব্যবহারসহ তাদের নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, দুই মাসের শাটডাউন তুলে নেয়ার পরে মানুষের চলাচল বেড়ে গিয়ে দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকারের ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করা গেলে এ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, বাসা থেকে কেউ বের হতে চাইলে তাদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, অফিসে ও যানবাহনের যেকোনো স্থানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো কিছু স্পর্শ করার পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।
অধ্যাপক বড়ুয়া বলেন, ‘জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সরকার শাটডাউনটি তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখন সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশিকা কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে। পুনরায় শুরু হওয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রভাব সরকার পর্যবেক্ষণ করবে এবং দুই সপ্তাহ পরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।’
গণপরিবহন পুনরায় চালুর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যদিও সীমিত সংখ্যক যাত্রী বহন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তবে গণপরিবহনে মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত এতে এ নির্দেশনা বজায় রাখা সম্ভব হবে কি না এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’
সতর্ক করে দিয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, যাত্রীরা যদি মাস্ক না পরে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তবে ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে। মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রীকে যানবাহন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না।
‘ভুল পদক্ষেপ’
আন্তজেলা বাস চলাচল পুনরায় চালু করে দেয়ায় করোনভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসা অব্যাহত থাকবে।
বিএসএমএমইউ উপার্চায বলেন, ‘স্বাস্থ্য নির্দেশনা না মেনে যেভাবে ছুটি কাটিয়ে মানুষ ফিরে আসা শুরু করেছেন তাতে ভাইরাসের আরও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আমরা ধরে নিতেই পারি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ জুন অবধি বাড়বে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বি-নাজির আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রান্তে সংখ্যা বাড়ছে সে সময়ে শাটডাউন তুলে নেয়াটা ভুল ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এর ফলে নিঃসন্দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আমরা পুরো জুন মাস জুড়েই ভাইরাসের মারত্মক প্রাদুর্ভাব দেখতে পাব।’
তিনি বলেন, ‘সরকারকে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার পরে ধীরে ধীরে শাটডাউনটি তুলে নেয়া উচিত ছিল। শাটডাউনটি তুলে নেয়ার আগে কীভাবে আমরা নিরাপদে পরিবহন সেবা পরিচালনা করতে পারি সে সম্পর্কে পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার দরকার ছিল।’
কোনো ধরনের লক্ষণ ছাড়া বিপুল সংখ্যক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন উল্লেখ করে এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, লক্ষণ ছাড়া এসব রোগীর এখন অফিস, রেস্তোরাঁ, চা স্টল এবং পরিবহনে সর্বত্র যাতায়াত করার ফলে অত্যান্ত দ্রুত এ ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটির দিনগুলোতে মানুষের নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরার কারণে টানা দুই দিন নতুন করে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজারও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আগামী দিনগুলোতেও আমরা বিপুল পরিমাণে আক্রান্ত রোগী দেখতে পাব। শাটডাউনটি তুলে নেয়ার প্রভাব এ মাসের শেষেই আমরা বুঝতে পারব এবং এর পরিণাম যে ভয়াবহ হবে তা নিয়ে আমার ভয় হচ্ছে।’
ডা. বি-নাজির আহমেদ বলেন, হাসপাতালগুলোতে এত রোগীকে সেবা দেয়ার ক্ষমতা নেই বলে পুরো মাস জুড়ে প্রাণহানির ঘটনাও অনেক বেড়ে যাবে।
‘জাতির সমানে মহাবিপদ’
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে ১২ হাজারেরও বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। আগামী সপ্তাহেও যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে হাসপাতালগুলো বাড়তি রোগীদের চিকিৎসা কীভাবে নিশ্চিত করবে? ফলে, গুরুতর রোগীদের বাঁচাতে আইসিইউ এবং অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ভাইরাস সংক্রমণকে ধীর করার জন্য নজরদারি এখন আরও কড়া করতে হবে যাতে সরকারের তৈরি নির্দেশিকা সবাই মেনে চলেন। মাস্ক না পরে কাউকে বাসা থেকে বেরোনোর অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না। সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত।’
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, দৈনিক পরীক্ষা করা মানুষদের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরিমাণ ৫-১০ শতাংশে নেমে আসার পর এ শাটডাউন শিথিল করা যেত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পরীক্ষা করা রোগীদের মধ্যে আক্রান্তের পরিমাণ এখন ২১ শতাংশের বেশি। তাই, আমি মনে করি আমরা অফিস এবং পরিবহন পুনরায় চালু করে দিয়ে জাতির জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছি।’
বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন স্বাস্থ্যবিধি, সরকারের নির্দেশিকা এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো কঠোরভাবে মেনে চলে মানুষের দায়িত্ব হবে নিজেকে এ ভাইরাস থেকে বাঁচিয়ে চলা।
সরকারের নির্দেশনা মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিন
গত ২৮ মার্চ দেশের আটজন নামকরা চিকিৎসক নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি দল গঠন করে। এতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও মহামারি প্রতিরোধের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগ থেকে একজন করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা তাদের পরামর্শ এবং নির্দেশনাসহ একটি ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, সরকারের দেয়া নির্দেশনা মেনে চললে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার সাথে সাথে করোনাভাইরাস বিপজ্জনক হয়ে উঠবে না।
তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্প কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার সময় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন যে অনেক শ্রমিক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন। তবে বাস্তবে তা ঘটেনি। বোরো ফসল কাটার জন্য সাড়ে তিন লাখ কৃষি শ্রমিক এক জেলা থেকে অন্য জেলাতে যাতায়াত করেছিলেন। তখনও আমরা শুনিনি তারা ভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছেন। অবশ্যই নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা এখন কিছুটা বাড়তে পারে। তবে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
ঢাকা, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামকে করোনা সংক্রমণের হটস্পট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওই অঞ্চলগুলোতে ক্লাস্টার লকডাউন কার্যকর করতে হবে।
ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা এখন খুবই জরুরি উল্লেখ করে ফয়সাল বলেন, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় নেতাদের অবশ্যই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মানুষকে বোঝাতে ও অনুপ্রাণিত করতে পারি যে এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে তাদের নিজেদের চেষ্টা করতে হবে, তবে তারা নিজেরাই কাউকে বাড়ি থেকে বের হতে এবং মাস্ক ছাড়া চলাচল করতে দেবেন না। তারা নিজেরাই কোনো আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবাধে চলাফেরা করতে দেবেন না। যদি কোনো পরিবার বা বাড়ি লকডাউনে রাখা হয় তবে তারা নিজেরাই তাদের সহায়তা করতে পারবেন।’